কারার ঐ লৌহ-কবাট এর কপিরাইট কার?
১০ নভেম্বর প্রাইম ভিডিও ওটিটিতে আইছে হইল ভারতীয় পরিচালক রাজা কৃষ্ণণ মেনন এর মুভি পিপা (২০২৩)। ১৯৭১ সালের কাহিনী। “ইন্ডিয়া-পাকিস্তান” যুদ্ধ লইয়া ভারতীয় ছবি।
ছবিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান 'কারার ঐ লৌহ-কবাট' (গানের টেক্সটে আছে 'কবাট', কাজেই কপাট হবে না) এর রিমেক হইছে। করছেন ভারতীয় মিউজিশিয়ান এ আর রহমান।
মুভিতে যেই রকম কুসুরে ও মেধাহীন ভাবে গাওয়া হইছে ঐতিহাসিক এই গান, তা লইয়া প্রচুর নিন্দা কামাইছেন এ আর রহমান। ভারতীয় বাঙালি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী বলছেন, “এটা নিয়ে তো মামলা হওয়া উচিত! এ আর রহমানের মতো একজন এত নামি লোক, এটা কী করলেন!“
আমাদের এইখানেও অনেকেই দেখলাম নজরুলের গানের তেরোটা বাজাইয়া দেওয়ার কারণে এ আর রহমানের শাস্তি চাইতেছেন।
আমার আলাপ মূলত নজরুলের এই গানে এ আর রহমান সুর করার অধিকার রাখেন কিনা তার উপর।
এমনিতে এ আর রহমানের গান আমার কখনোই ভাল লাগে না। এই ফাঁকে রুচির কথাটা একটু জানান দিয়া দিলাম। মাইন্ড কইরেন না ভক্তকুল!
২.
বাংলাদেশে প্রকাশিত সাহিত্য, নাটক, সংগীত ও শিল্পকর্মে কপিরাইটের মেয়াদ হইল আর্টিস্টের মৃত্যুর পরে ৬০ বছর।
কপিরাইট অফিসের মতে: "প্রণেতার জীবনকালে প্রকাশিত কোনো সাহিত্য, নাটক, সংগীত বা শিল্পকর্মের (ফটোগ্রাফ ব্যতীত) কপিরাইট তাহার জীবদ্দশায় এবং তাহার মৃত্যুর পরবর্তী ৬০ (ষাট) বৎসর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকিবে।"
কবি কাজী নজরুল ইসলাম মারা গেছেন ১৯৭৬ সালে—মোটামুটি ৪৭ বছর হইছে। কাজেই নজরুলের বই, সাহিত্য এবং গানের কপিরাইট বিদ্যমান থাকার কথা তার নামেই—অর্থাৎ তার উত্তরাধিকারীরা এই সব কিছুর স্বত্ব পাইছেন নিশ্চয়ই।
তবে সমস্যা হইল উনি যেহেতু অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে সাহিত্য কইরা গেছেন তাই ওনার বই, সঙ্গীত এই সবের কপিরাইট দুই দেশের নিয়ম অনুসারে আলাদা হওয়ার কথা। যদি না বাংলাদেশের কপিরাইট দপ্তরটি অন্য অনেক কিছুর মতই ভারতের কপিরাইটের নিয়ম অনুসরণ করে!
সেক্ষেত্রে ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পী এ আর রহমান নজরুলের গানের সুরের কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংকোচন করতে পারেন না—আইনত।
কিন্তু লৌহ-কবাট গানের ক্ষেত্রে সমস্যাটা একটু আলাদা।
৩.
ফেসবুক ফ্রেন্ড চঞ্চল বাশার এর কমেন্ট থিকা জানলাম, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানটা প্রথম গাইছেন গিরিন চক্রবর্তী, 'চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন' (১৯৪৯) সিনেমায়।
এবং আমরা প্রায় সবাই জানি, ১৯৪২ সাল থিকা বাদবাকি সারাজীবন নজরুল মানসিক ভারসাম্যহীন ও অসুস্থ্য ছিলেন। কাজেই তার অনুমতি ক্রমে গানে সুরারোপের প্রশ্ন আসে না।
হয়ত তার পরিবারের কারো অনুমতি সাপেক্ষে ছবির পরিচালক নির্মল চৌধুরী তার মুভিতে অন্য কাউরে দিয়া সুরারোপ করছিলেন, যেইটারে আমরা নজরুলের সুর হিসাবে মান্য করি।
তাইলে সন্দেহ করা যাউক: কারার ঐ লৌহ-কবাট গানের সুর হয়ত নজরুলের ছিল না।
তাইলে কার ছিল?
৪.
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৪৯) মুভিতে মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন দুইজন—কালীপদ সেন ও দ্বিজেন চৌধুরী।
গিরিন চক্রবর্তী গাইছেন বটে, তবে তিনি নিশ্চয়ই সুরকার ছিলেন না। ওই মুভির সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনরাই বলতে পারবেন নজরুলের গান কারার ঐ লৌহ-কবাট এর সুর কে দিছিলেন।
আবার নজরুলের গাওয়া সুরেই যে মুভির গানে তারা সুর দেন নাই তা কি নিশ্চিত?
১৯৪৯ সালের ওই সিনেমার আগে কোনো সভা, অনুষ্ঠান, দাওয়াত বা রেকর্ডে নজরুল এই গান গাইছিলেন কিনা তা জানা গেলে উত্তম হইত। কবিতাটা গান হিসাবেই লেখা হইছিল ১৯২১ সালে, দ্বিতীয় সংস্করণেও দেখছি যে কবিতার শুরুতে ব্রাকেটে "(গান)" বলা আছে।
নজরুল সক্রিয় থাকাকালে হারমোনিয়াম লইয়া তার লেখা প্রায় সব গানই গাইতেন। ভাঙার গান বইয়ের দ্বিতীয় গান 'জাগরণী' লইয়া সেই রকম একটা গল্প আছে। গল্পটা শোনেন:
“১৯২১ সনে শ্রীযুত বীরেন সেন (কাজীর এবং আমাদের সকলের ‘রাঙা দা’) তখন কুমিল্লা বিদ্যালয়ে শিক্ষক। কাজী নজরুল কান্দিরপার তাঁরই বাড়ীতে থাকেন। প্রিন্স অব ওয়েল্সের ভারত-ভ্রমণ উপলক্ষে কংগ্রেস-ঘোষিত হরতাল-পালনের জন্য (২১শে নভেম্বর) একটি গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ নিয়েই প্রথম তাঁর সাথে দেখা করি ‘রাঙা দা’র বাড়ীতে। তিনি তা তো দিলেনই, অধিকন্তু কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে মিছিলের সঙ্গে তিনি নিজেও গাইলেন:
ভিক্ষা দাও। ভিক্ষা দাও
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান দ্বারে উপবাসী,
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও।”
— আফতাব-উল-ইসলাম, গুলিস্তাঁ, নজরুল-সংখ্যা
কাজেই লৌহ-কবাট এর সুর নজরুলেরই হওয়ার কথা। আসলে তার কিনা তা জানার সুযোগ আমাদের আছে। ধীরে তা জানা যাবে।
৫.
আপাতত যেই কারণে নজরুলের এই গানের (বা কবিতার) কপিরাইট নজরুলের নাও থাকতে পারে, সেই আলাপ করি।
উইকিপিডিয়া থিকা অদ্য জানতে পারলাম, ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে ব্রিটিশ রাজের তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার কখনও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নাই।
নিষিদ্ধ ‘ভাঙার গান’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ বাইর হয় ১৯৪৯ সালে। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী লিমিটেড থেকে সুরেন দত্ত বাইর করেন এই কাব্যগ্রন্থ। বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় রাবার ষ্ট্যাম্পের ছাপ্পড় দেওয়া ছিল, “সম্পূর্ণ লভ্যাংশ কবির সাহায্যে দেওয়া হইবে।”
অর্থাৎ নিষিদ্ধ বইটাই বাইর হইছে পরে। ব্রিটিশ সরকার এইটারে সিদ্ধ কইরা যাইতে পারে নাই বা সিদ্ধ করতে চায় নাই।
বইটির পরবর্তী সব সংস্করণই নিষিদ্ধ বইয়েরই সংস্করণ কিনা তা ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশের কপিরাইট অফিস ভাল জানবেন।
যদি তা হইয়া থাকে তাইলে তারা কেন এই বই সিদ্ধ করলেন না সেই প্রশ্ন জাগরূক তাকে। তারা তাইলে কী করেন, সেই প্রশ্নও।
৬.
উইকিপিডিয়া বলতেছে যে ব্রিটিশ শাসন চলে যাওয়ার আগে "ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ প্রদেশগুলিকে ভাগ করে দুটি অধিরাজ্য সৃষ্টি করা হয়। এই দুটি ছিল যথাক্রমে ভারত অধিরাজ্য ও পাকিস্তান অধিরাজ্য।"
অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজ বৈধভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল।
কাজেই এই দুই অধিরাজ্য এবং তা থিকা উৎপত্তিজাত রাজ্যসমূহ যেইসব ব্রিটিশ আইনের কোনো চেইঞ্জ আনবে না সেসব আইন বহাল থাকবে।
এখনও বহু ব্রিটিশ আইন পরিবর্তনহীন ভাবে বর্তমান আছে আমাদের দেশে। আলস্যবশতঃ ভারত-পাকিস্তানের কথা খোঁজ করি নাই।
কাজেই ব্রিটিশের নিষিদ্ধ বই আইনত সিদ্ধ না করা হইলে তার কপিরাইট তৈরি হবে না।
জিনিসটা আইনসঙ্গত হওয়া না হওয়ার বিষয়। মানে হইল, বেআইনি বইয়ের স্বত্ব থাকে না লেখক কিংবা প্রকাশকের।
পরবর্তী বৈধ সরকার এই বইরে আইন কইরা সিদ্ধ করছে, তেমন ঘটনা আছে কি?
যদি না থাকে এইটা তো নিষিদ্ধ বইই। অন্তত কপিরাইট কাজ করার কথা না নিষিদ্ধ বইয়ের ক্ষেত্রে, আইনত।
কাজেই মহাশয় এ আর রহমান নজরুলের এই গানের তেরোটা বাজাইয়া দেওয়ার অধিকার রাখেন।
কেননা, দেশপ্রেম আর আইনপ্রেম সমান তালে চলে না।
১১/১১/২০২৩