বদরুদ্দীন উমর, ছবি সমকাল থেকে
• "অন্ধকারের যুগ আরম্ভ হলো একাত্তর সালের পর। এখন আপনি চারদিকে তাকিয়ে দেখেন কিছুই পাবেন না।"
• "এখন সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কেউ নেই।"
— বদরুদ্দীন উমর, সাক্ষাৎকার ২০২১, সমকাল
* * *
কেবল বদরুদ্দীন উমর-এরই নয়, প্রচুর বিদগ্ধ পাঠকের ধারণা যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই ছিল আমাদের শিল্প-সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। ১৯৭১ এর পরে অন্ধকার যুগ আরম্ভ হইছে। কোনো শিল্প-সাহিত্য কিছু হয় নাই! সব খালি।
এই ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করছেন ওনারাই। ওনাদের কাছ থিকা শুইনা শুইনা এখন সকলেই এই রকম বলে!
"একাত্তরের পরে আর কিছু হয় নাই" বলাটা আন্দাজি বক্তব্য মাত্রই না, এই রকম জনশ্রুতির কারণে বহু সম্ভাবনাময় লেখক-শিল্পী তাদের যোগ্য গুরুত্ব ও সম্মান আর পান না, দর্শক-পাঠকের কাছ থিকা।
এই রকম মিথ্যাচাররে আমি গর্হিত প্রচার মনে করি। সেইটা বদরুদ্দীন উমর বললেও মিথ্যাচারই।
সে কারণে নিচে আমি কিছু পরিসংখ্যান দিতেছি। এইটা স্রেফ উপন্যাস বিষয়ক পরিসংখ্যান। যা থিকা বোঝা যাবে একই ঔপন্যাসিকের ৭১ এর আগের-পরের প্রকাশিত উপন্যাসের খতিয়ান।
এর বাইরে কিছু লেখক আছেন যারা ৭১ এর পরে আর লেখেন নাই, আবার অনেক ঔপন্যাসিক আছেন ৭১ এর আগে কিছু লেখেন নাই। তাদের কথাও আসবে।
তা দেইখা আপনারা নিজেরাই একটা ধারণায় পৌঁছাইতে পারবেন বদরুদ্দীন উমর-এর অন্ধকার যুগ বিষয়ক চিন্তা কতটা ভ্রান্ত চিন্তা।
লোকমুখে শুইনা শুইনা আপনার মধ্যেও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হইতে পারে। কিন্তু যা কিছু সংখ্যার হিসাবে স্পষ্ট হইতে পারে সে বিষয়ে মিথ্যাচার করার কী দরকার?
নিচে একই ঔপন্যাসিকদের '৪৭ থেকে '৭১ এবং '৭১ টু পরবর্তীকালীন উপন্যাসের নাম ও সাল দেওয়া হইল।
তথ্যগত ভুল থাকলে ধরাইয়া দিয়েন।
সম্মানিত বদরুদ্দীন উমরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাদেরকে একটা জরুরি কাজে ব্রতী করলেন।
১. শামসুদ্দীন আবুল কালাম
গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। স্বর্ণযুগে লেখা তার উপন্যাস ৫টি:
আলমনগরের উপকথা (১৯৫৪)
কাশবনের কন্যা (১৯৫৪)
দুই মহল (১৯৫৫)
কাঞ্চনমালা (১৯৫৬)
জীবনকাব্য (১৯৫৬)
*
অন্ধকার যুগেও ৬টি:
জায়জংগল (১৯৭৮)
মনের মতো ঠাই (১৯৮৫)
যার সাথে যার (১৯৮৬)
সমুদ্রবাসর (১৯৮৬)
নবান্ন (১৯৮৭)
কাঞ্চনগ্রাম (১৯৯৭)
২. শওকত ওসমান
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক। তার ৪টি উপন্যাস ৭১ পূর্ববর্তী স্বর্ণযুগে লেখা। এগুলি হইল:
জননী (১৯৫৮)
ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২)
সমাগম (১৯৬৭)
চৌরসন্ধি (১৯৬৮)
*
আর অন্ধকার যুগে লিখছেন:
রাজা উপাখ্যান (১৯৭১)
জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১)
দুই সৈনিক (১৯৭৩)
নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩)
পতঙ্গ পিঞ্জর (১৯৮৩)
আর্তনাদ (১৯৮৫)
রাজপুরুষ (১৯৯২)
জলাঙ্গী (১৯৭৬)
৩. আলাউদ্দিন আল আজাদ
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। 'বদরুদ্দীন উমর স্বর্ণযুগ'-এ লেখা তার উপন্যাস ৪টি:
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০)
শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথম দিন (১৯৬২)
কর্ণফুলী (১৯৬২)
ক্ষুধা ও আশা (১৯৬৪)
*
৭১ পরবর্তী অন্ধকার যুগে ১৪টি:
খসড়া কাগজ (১৯৮৬)
শ্যাম ছায়ার সংবাদ (১৯৮৬)
জ্যোৎস্নার অজানা জীবন (১৯৮৬)
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি (১৯৮৬)
স্বাগতম ভালোবাসা (১৯৯০)
অপর যোদ্ধারা (১৯৯২)
পুরানা পল্টন (১৯৯২)
অন্তরীক্ষে বৃক্ষরাজি (১৯৯২)
প্রিয় প্রিন্স (১৯৯৫)
ক্যাম্পাস (১৯৯৪)
অনূদিত অন্ধকার (১৯৯১)
স্বপ্নশীলা (১৯৯২)
কালো জ্যোৎস্নায় চন্দ্রমল্লিকা (১৯৯৬)
বিশৃঙ্খলা (১৯৯৭)
৪. রশীদ করীম
প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক। তার ২টি উপন্যাস 'বদরুদ্দীন উমর স্বর্ণযুগ'-এ লেখা:
উত্তম পুরুষ (১৯৬১)
প্রসন্ন পাষাণ (১৯৬৩)
*
৭১ পরবর্তী অন্ধকারে বইসা লেখা ১০টা:
আমার যত গ্লানি (১৯৭৩)
প্রেম একটি লাল গোলাপ (১৯৭৮)
সাধারণ লোকের কাহিনী (১৯৮১)
একালের রূপকথা (১৯৮১)
শ্যামা (১৯৮৪)
বড়ই নিঃসঙ্গ (১৯৮৫)
মায়ের কাছে যাচ্ছি (১৯৮৯)
চিনি না (১৯৯০)
পদতলে রক্ত (১৯৯০)
লাঞ্চ বক্স (১৯৯৩)
৫. শওকত আলী
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। ৭১ পূর্ববর্তী উপন্যাস তার মাত্র ১টি:
পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩)
*
তিনি দেখা যাচ্ছে অন্ধকারেই সব লিখছেন:
যাত্রা (১৯৭৬)
প্রদোষে প্রাকৃতজন (১৯৮৪)
অপেক্ষা (১৯৮৪)
দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫)
কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬)
পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬)
সম্বল (১৯৮৬)
গন্তব্যে অতঃপর (১৯৮৭)
ভালোবাসা কারে কয় (১৯৮৮)
যেতে চাই (১৯৮৮)
ওয়ারিশ (১৯৮৯)
বাসর ও মধুচন্দ্রিমা (১৯৯০)
উত্তরের খেপ (১৯৯১)
প্রেম কাহিনী (১৯৯১)
পতন (১৯৯২)
অবশেষে প্রপাত (১৯৯৬)
দলিল (২০০০)
জননী ও জাতিকা (২০০১)
হিসাব নিকাশ (২০০১)
স্ববাসে প্রবাসে (২০০১)
তনয়ার স্বীকারোক্তি (২০০১)
জোড় বিজোড় (২০০১)
ঘরবাড়ি (২০০১)
শেষ বিকেলের রোদ (২০০১)
এক ডাইনীর খেলা (২০০১)
নাঢ়াই (২০০৩)
বসত (২০০৫)
স্থায়ী ঠিকানা (২০০৫)
দুই রকম (২০০৫)
কাহিনী ও কথোপকথন (২০০৭)
মাদারডাঙ্গার কথা (২০১১)
৬. মাহমুদুল হক
স্বর্ণযুগে মাহমুদুল হকের উপন্যাস দুইটি:
অনুর পাঠশালা (১৯৬৭)
নিরাপদ তন্দ্রা (১৯৬৮)
*
অন্ধকার যুগে ৬টি:
জীবন আমার বোন (১৯৭২)
কালো বরফ (১৯৭৭)
অশরীরী (১৯৭৯)
পাতালপুরী (১৯৮১)
খেলাঘর (১৯৮৮)
মাটির জাহাজ (১৯৭৭)
২৮/২/২০২৩
এই অবজারভেশনটা নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিলো, ধরেন যিনি ১৯৭১ এর আগে প্রকাশিত হয়েছে, তাদের পরবর্তী বইগুলো একাত্তর পরবর্তী হলেও তারা স্বর্ণযুগের লোকই, বরং একাত্তর পরবর্তী আত্মপ্রকাশ করা লেখক দের উপরই কি উনার বক্তব্য ফোকাস করে? আমিও আপনার বক্তব্যের সাথে একমত, অন্ধকার যুগে যাই আসুক তা স্বর্ণযুগের মানুষ লিখলেও অন্ধকারই, কারণ তাদের হাত দিয়ে এই অন্ধকার তো দূর হয় নাই, বরং এটা বলা যেতে পারে তারাই অন্ধকার যুগের সূচনার মূল কারণ। সেই ক্ষেত্রে খোদ বদরুদ্দীন উমর সাহেবও এই দায় এড়াতে পারেন না, উনাকে বরং অন্ধকার যুগে জনক হিসেবে ধরা যেতে পারে, উনার এই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে। তো যাই হোক যেহেতু, আপনি এইকাজে নেমেছেন, তাই জানতে আগ্রহী, সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে যারা যারা আত্মপ্রকাশ করেছে, তাদের একটা তালিকা কি এই অর্থে করা যায়? যেমন ধরেন শহিদুল জহির, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ স্বাধীনতা পরবর্তী যারা আছেন, তাদের তালিকা। তারপরে তথাকথিত স্বর্ণযুগ আর অন্ধকার যুগের তুলনামূলক আলাপও করা যেতে পারে।