চাটুকারিতা কেন ভাল
১.
প্রশংসা ও নিন্দার বাইরের এক বিষয় চাটুকারিতা। সাধারণ ধারণায় নিন্দার বিষয়রে প্রশংসা করার নামই চাটুকারিতা।
কিন্তু কথা হইল, প্রশংসার যা বিষয় তারে যে প্রশংসাই করা উচিৎ, আর নিন্দার বিষয়রে নিন্দা—এই কর্তব্য নির্ধারণ কইরা দিল কে?
কারা এইটা ঠিকঠাক করে?
ক্ষমতা তার "সততা" নামক অস্ত্র দিয়া সমাজের জন্যে ঠিক কইরা দেয়, কোনটারে প্রশংসা করতে হবে, আর কোনটারে নিন্দা।
সোসাইটিও তার পরিবার, বিদ্যালয়, প্রার্থনালয়, সমিতি, সংঘ, উৎসব ও আড্ডার মাধ্যমে ক্ষমতার এই "যা করতে হবে তাই করো" নামক ধারাটি প্রবহমান রাখে।
ফলে আমরা—মানে আমি বাদে অন্যেরা—প্রশংসার জিনিসরে প্রশংসা করে, নিন্দার জিনিসরে করে নিন্দা।
এবং এরই নাম তারা দেয় সমাজ ও ঐতিহ্য।
২.
কিন্তু সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজরে বদলাইয়া দেওয়া যায়।
পুরাতন ইতিহাস ও ঐতিহ্যরে জলাঞ্জলি দিয়া নতুন ইতিহাস ও ঐতিহ্য আবিষ্কার ও লইয়া আসা সম্ভব। তবে তার পরেও নতুন প্রশংসার জিনিসরে প্রশংসাই করতে হয় আর নতুন নিন্দার জিনিসরে নিন্দা।
হায়!
তাইলে সোসাইটিরে চেঞ্জ কইরা কী লাভ হবে? মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও অবজ্ঞার ধারাগুলি তো তাতে বদলাবে না।
সে কারণেই দরকার যেকোনো অবস্থায় প্রশংসা ও নিন্দার ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপনরে প্রকাশ হইতে দেওয়া।
সমাজ বদলের অপেক্ষা না করা, বরং চাটুকারিতার মাধ্যমে সমাজ বদলের কাজ চালানোই বৈপ্লবিক ক্রিয়াশীলতা।
৩.
বিদ্যমান সত্য ও ভালোর যারা তল্পিবাহক তারাও এক অর্থে চাটুকারিতাই করেন। তারা না বুইঝাই যখন ভেড়ার পালের ধারায় ভাল ও মন্দ বলেন সেও এক ধরনের চাটুকারিতাই। বুদ্ধি ও কৌশলহীন সত্য বা স্থিতিশীলতার গীতি বা চাটুকারিতা।
কিন্তু তারা সংখ্যায় এত বেশি যে তা তাদের নিজেদের কাছে তা সত্যের বিকল্প হিসাবে ধরা দেয়। কারণ সংখ্যার আধিক্যই আমাদের জগতে সত্য রূপে ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। এবং সেখানে সকলের জন্যে চাটুকারিতার একটি মাত্র রূপ। কাজেই তা কাজ করে না।
তাই আমাদের দরকার একই সঙ্গে একাধিক ও পরস্পর বিরোধী সত্যের উদ্ভব ঘটানো। এর মাধ্যমে সত্যের ক্ষমতা হ্রাসই বহুত্বের বা বহুমতের মুক্তি ঘটাইতে পারে।
সে দিক থিকা সোসাইটিতে যা আছে তার অর্থের বদল ঘটাইয়া দেওয়াই সহজ ও দ্রুত ফললাভের উপায়।
প্রশংসা, তোষামদ ও চাটুকারিতা তার কলকব্জা ও মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রম দিয়া নয়া নয়া সত্য উৎপাদনের মাধ্যমে সমাজের গাইড়া বসা টার্ম ও তার অর্থের বদল ঘটায়। নতুন নতুন চাহিদা তৈরি ও সরবরাহ শুরু করে চাটুকারিতা। পুরাতন মনস্তাত্ত্বিক সমাজ, যা প্রায় ধর্মে পরিণত, তার বিলোপ ঘটায়।
ক্ষমতাবানরা বাস্তবে সব না পাইলেও চাটুকাররা তাদের সব অপ্রাপ্তিরে "যেন পাইছি"তে পরিণত করতে সক্ষম। এইটা চাটুকারিতার বৈপ্লবিক ক্রিয়া।
ইতিহাস ও সংজ্ঞা ভিত্তিক 'বাস্তবতা'রে এড়াইয়া উদ্দেশ্যকে বাস্তব-এ পরিণত করতে পারে চাটুকাররা। তাদের হাতে নতুন সত্য তৈরি হয়। বাস্তবে যা তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে না!
চাটুকারিতার মাধ্যমে এই সত্য শুধু ক্ষমতাবানদের জন্যেই তৈরি হয়। বিরোধীরা তা দেখতে পায় না। তবে যা কাজ হওয়ার তা হয়। অর্থাৎ চাটুকারদের মন্ত্রণা বা উচ্চারিত সত্য—ফল উৎপাদনকারী কাজের মাধ্যমে— ক্ষমতাবানদের দ্বারা—দ্রুত পুরাতন সমাজের বদল ঘটাইতে থাকে ।
ক্ষমতাহীনরা কেবলই ভোক্তা সমাজ। তারা যেকোনো ক্ষমতা কাঠামোরেই মাইনা নেয় বইলাই যেহেতু তারা ক্ষমতাহীন, কাজেই সমাজ ক্ষমতাবানদের হাতে থাকে।
চাটুকারিতা ক্ষমতাবানদের কর্তব্য নির্ধারণ, নতুন মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা ও অভ্যাস তৈরির মাধ্যমে তাদের হাতে অর্পিত সমাজের লক্ষ্য ও গন্তব্যরে বদলাইয়া নিজেদের স্বার্থ কায়েম করে।
চাটুকারিতা এইভাবে মূলত পুরাতন সত্যের শত্রু বা সংহারক। ক্ষমতাবানদের ব্যক্তি অবস্থানরে সমাজের উপরে তুইলা ধরা ও নানান অলঙ্কারে তা প্রচার করতে থাকাই তার সবচাইতে বড় কাজ। যে যত বেশি নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে এই কাজ করতে পারে সে তত বেশি চাটুকার, তত তার সম্মোহনী ক্ষমতা।
এই সম্মোহনের বড়ি দিয়াই তার কাজ সারে চাটুকারিতা। রাজা বা নৃপতিদের আমলেও এইভাবেই কাজ সারত তারা। ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রক ছিল তারাই। সে অবস্থার কোনোই বদল ঘটে নাই। ঘটবেও না। ঘটার দরকারও নাই।
চাটুকারিতা ক্ষমতার জন্যে বিভ্রম তৈরি করে এবং ক্ষমতারে কাজে লাগাইয়া নিজের প্রভাব বলয় তৈরি করে। এবং কালক্রমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে।
এই চক্ররে সামাল দেওয়া যেহেতু ক্ষমতাবানদের পক্ষেই সম্ভব হয় না, কাজেই ক্ষমতাহীন বা আদর্শবাদী পক্ষের পক্ষে তা অসম্ভব ব্যাপারই।
৪.
তেল মারা বা দেওয়া, তোষামদ করা, চাটুকারিতা করা, অতি প্রশংসা করা, কারো মধ্যে যা নাই তা আবিষ্কার কইরা দেখানো, দালালি করা—এগুলি মানুষের মহত্তম বা সুন্দরতম গুণ।
কারণ, এই জিনিসগুলি দুনিয়াতেই কারো কারো জন্যে স্বর্গ রচনা করে। এরমধ্যে দালালি সবচাইতে মহৎ কর্ম, যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিঃস্বার্থ কর্ম হইয়া থাকে।
অর্থের বিনিময়ে দালালিকে ঠিক দালালি বলাও যায় না। সেইটার অন্য ব্যবসায়িক নাম থাকা উচিৎ বা থাকে।
একই রকম ভাবে বা বিপরীত ভাবে যা পুরাপুরি আপনার না কিন্তু আপনার হইতেই পারত সেই সেমি সত্য বা মিথ্যারে সত্য কইরা তুলতে পারে যারা তাদেরকে যোগ্য সম্মান ও বিনিময় মূল্য দেওয়াটা বিজনেস হিসাবে অনেক সুন্দর।
সত্যিকার অর্থেই সুন্দর।
বিজনেস যেহেতু কেবল প্রডাক্ট না বা কারখানায় বিলং করে না বরং বিজনেস কর্তাদের মন বা শান্তিরও অপর নাম বিজনেস, তাই এই তেল বা প্রশংসা বা চাটুকারিতা মারফৎ ক্ষমতাসীনদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার যে বিজনেসধারা তার গুরুত্ব অপরিসীম।
এর সবগুলিই যোগাযোগ দক্ষতার মধ্যে পড়ে।
অবশ্য যোগাযোগ দক্ষতার অর্ধেক বলা যায় এগুলিরে। পূর্ণ যোগাযোগ দক্ষতা বা কমিউনিকেশন স্কিল হইল এগুলির বিনিময়ে আপনি কতটা অর্জন করলেন বা পাইতে পারলেন!
অবশ্য যোগাযোগ দক্ষতারে বিজনেস হিসাবে দেখতে চান না আমাদের দেশের প্রথম প্রস্তর যুগের লোকেরা।
তারা "সততার পরাকষ্ঠা" নামক ব্যবসারেই শুধু ব্যবসা মনে করেন। যে ব্যবসা আটকাইয়া থাকে আশা ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে, যার কোনো ফললাভ ঘটে না!
এমনিতেও ফিলোসফিক্যালি বা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থিকা ব্যবসায় যেহেতু লাভ ঘটে, তাই তা পরম সৎ বা "যা-তাই" থাকতে পারে না। লাভ বা সমৃদ্ধি বা যোগ হওয়া বিজনেসের পরিসর বাড়াইয়া তোলে। যা ছিল না তা যখন যুক্ত হয় তারে আর "সৎ" বলা যায় না। সৎ বা সততা মানে হইল যা ছিল বা আছে তার চির একই অবস্থা।
তো এই যে প্রশংসা বা চাটুকারিতা সংক্রান্ত বিজনেস যা কর্তা ব্যক্তিদের মন প্রফুল্ল রাখে এগুলি যারা ভালো পারেন তাদেরকে বলা যায় মিনি বিজ্ঞাপনী সংস্থা। পেশাগত জীবনে যোগাযোগ দক্ষতা বলতে এর বাইরে কী আছে আমি জানি না।
কেউ যে রকম আছে তারে সেই রকম বলাটা কোনো কমিউনিকেশন না। বরং তা ব্যক্তি আক্রমণের মধ্যেও পড়তে পারে।
কমিউনিকেশন বা যোগযোগ টার্মটার বৃহৎ মানেই হচ্ছে মিথ্যা। কেবলই মিথ্যা না, আকাঙ্ক্ষিত সত্যরে সত্য দেখানোর মিথ্যা বা কল্পনা।
এবং মানুষ মানেও তাই। যা সে না তা হইয়া ওঠাই মানুষ। বা সে যে তা হইছে তা দেখাইতে পারাটা।
১২/৮/২০২২