ফৌজিয়া খান, ছবি. হাসান তারেক চৌধুরী
শিরোনামের এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে রাইসুকে আমি বন্ধু বিবেচনা করি। করি, প্রসঙ্গক্রমে নানাখানে বলিও তা। যেসব জমায়েতে বলি তারাও আমার বন্ধুই বটে শুনে অনেকে অবাক হয়/হন, অস্বস্তি বোধ করে/করেন। কিছুতেই মেলাতে পারে/পারেন না কী করে ‘ওই রাইসু’ ‘এই ফৌজিয়া’র বন্ধু হতে পারে!
রাইসুকে আপাতভাবে অমার্জিত মনে হয়। মনে হয়, বেয়াদব! কেউ কেউ ভাবেন, রাইসু অ্যাটেনশন সিকিং। এইরকম যারা ভাবেন রাইসুকে তারা দেখতে পারেন না। কেউ কেউ আবার এই রাইসুকেই পছন্দ করেন—ঈর্ষণীয় রকমের বেশি পছন্দ করেন!
রাইসু আসলে এমনই, তার নিজের মতন, যাকে আমরা সচরাচর দেখি না।
আমরা মানে কারা? আমরা মানে যারা ‘মধ্যবিত্ত’। মধ্যবিত্ত টাকা-সম্পত্তির মালিকানায়, মধ্যবিত্ত তথাকথিত মঙ্গল বা সু চিন্তায়। মার্জিত শোভন পোশাকে শরীর ঢাকা মধ্যবিত্ত আমরা যারা। আমরাই তারা যারা বইয়ে পড়া পাণ্ডিত্য অবিকল প্রমিত ভাষায় শোভন স্বরে যে কোনো জায়গায় অবিরল বলে যেতে পারি। এই আমরাই ‘আমাদের’ চারপাশে। এই ‘আমাদের’ সাথেই আমাদের উঠাবসা, চলাফেরা। এদের সাথেই আমাদের আরাম।
সব সময় এমন আরামজনদের সাথে অভ্যস্ত মানুষেরা রাইসুকে মেনে নেবে কেন? মানে না। মানে না বলেই অতি সম্প্রতি ফেসবুকে পড়া ঘটনা রাইসুর জীবনে ঘটে। কী ঘটনা? ওই যে কিছুদিন আগে ঢাকা ক্লাবে কোনো এক দাওয়াতে গিয়ে না খেয়েই বের হয়ে আসার মতেন ঘটনা।
পরিচয়ের পর থেকেই দেখছি, চেনাজানা অনেকেই রাইসুকে দেখতে পারেন না। আমার অবশ্য রাইসু সম্পর্কে অতি মুগ্ধতা কিংবা ঘৃণা কোনোটাই নাই। কিন্তু রাইসুকে আমি বন্ধু বলেই মানি। কারণ তারুণ্যের শুরুতে পরিচয় হওয়া রাইসুর সঙ্গে এখনও যখন কদাচ কদাচিত দু’এক সময় কথা হয় তখন মনের মধ্যে আরাম বোধ হয়। অকারণ ভদ্রতার মুখোশ পরা কথা বলতে বা শুনতে হয় না।
১৯৮৮ সাল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। ফল প্রকাশও হয়ে যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায়। সেই সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মৌলিক উৎকর্ষ নামে একটা পাঠচক্র করতাম। আমরা মানে তারা যারা সেখানকার বইপড়া কলেজ কর্মসূচির তৃতীয় ব্যাচ। ওখানে কলেজ কর্মসূচিতে আমরা মূলত সাহিত্য পড়েছি। মৌলিক উৎকর্ষে ইতিহাস বিজ্ঞান দর্শনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমাদের। সেই সময় রাইসু এলো। এলো তবে আমরা যারা বই পড়তাম, বই নিয়ে আলোচনা সভাগুলোতে মুখর থাকতাম রাইসু তেমন ছিল না। মানে পাঠচক্রের নির্ধারিত বইগুলো সে খুব একটা পড়ত বলে মনে পড়ে না। পড়ত না, না পড়াটা আড়ালও করত না। নির্ধারিত আলোচনায় বসতও না। কিন্তু আসত নিয়মিত। আগের সপ্তাহে বাড়ি নিয়ে পড়া বইটি আলোচনার পর কেন্দ্রের খোলা ছাদ কিংবা গাছতলায় আমাদের যে আড্ডা হত সেখানে সে ছিল সরব। সরব তার স্বভাবসুলভ রসিকতায়, অপ্রমিত বাংলায়। রাইসু তখন রইসউদ্দিন রাইসু। আমি তখনও জানি না, ও কবিতা লেখে, ছবি আঁকে, ক্লাসিক্যাল মিউজিক শোনে।
রাইসুর পোশাক পরিশীলিত মার্জিত মধ্যবিত্তিক ছিল না—ছিল একটু আউলা ঝাউলা। আবার ধনী ঘরের বাউলা ধরনেরও ছিল না। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটাও খুব সাধারণ। মাথার চুল চিরুনিতে আঁচড়ানো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই রকম পোশাকে অপ্রমিত বাংলায় তীব্র তীক্ষ্ন বিদ্রূপে টইটুম্বুর রাইসুকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই সহ্য করতে চাইত না।
সেই সময় রাইসুর মতন পোশাকে আদিত্য কবিরকেও দেখেছি। (আদিত্যর বাবা প্রয়াত কবি হুমায়ুন কবীর। ওর মা রেবু আপা শামসুন্নাহার হলের হাউজ টিউটর। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত আর্ট-কালচার করা মানুষেরা নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ওদের বাসায় যাতায়াত করেন। আমি নিজেও গেছি দু’এক সময়।) অবাক যে, রাইসুকে কারোর কারোর ‘অসহ্য’ মনে হলেও কাছাকাছি পোশাকের আদিত্যর ব্যাপারে লোকজনের তেমন ইমপ্রেশন দেখি নাই!
কেন?
এই কেনর উত্তর এখন খুব স্পষ্ট করে বুঝি। কিন্তু তখনও এর উত্তর এতটা খোলা ছিল না। না আমার নিজের কাছে, না আমাদের সমাজে। উত্তরটা আসলে ওই ‘শ্রেণিতে’ ঢাকা পড়ে আছে। কিন্তু আমাদের সমাজে শ্রেণির বিভাজনটা এখনকার মতন তখন (৯০ দশকের গোড়ার দিককার কথা বলছি) পুরোপুরি টাকার মালিকানায় গিয়ে ঠেকে নি। আউলা ছেলে আদিত্য স্পঞ্জ পায়ে, কখনও বা খালি পায়ে শহরময় ঘুরে বেড়ালেও ওকে নিজেদের মধ্যে নিতে আমাদের মতন মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিসেবীদের অসুবিধা হত না। আর্ট-কালচার করা শীলিত শোভন সমাজ আদিত্যর পরিবারকে চিনত। কিন্তু শোভন সমাজের চোখে ‘র’ রাইসুর পরিবারকে তো কেউ জানত না। আমরা কেবল জানতাম, ও বাড্ডা থেকে আসে। বড়লোকের অভিজাত পাড়া গুলশানের ঠিক পাশেই থাকা বাড্ডা তখনও কুলীন অনেকের থাকবার জায়গা হয়ে ওঠে নি! ফলে পোশাকে, আচারে কাছাকাছি আদিত্য কবিরকে মেনে নিলেও রাইসুকে নিতে অনেকেরই অনীহা ছিল। রাইসু তাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমাদের সেই তথাকথিত কুলীন সার্কেলে একটু আলটপকাই ছিল!
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে রাইসুকে আমার মূলত চোখে পড়েছে নির্দ্বিধায় অপ্রমিত ভাষায় কথোপকথন আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধের কারণে।
আমাদের বয়সী কারোর মধ্যে তখনও অত রসবোধ দেখি নি। তখনকার চেনাজনদের মধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকেই সবচে রসিক দেখেছি। সায়ীদ স্যার কথায় কথায় উইট করতেন। আমরা হো হো করে হাসতাম। সায়ীদ স্যারের উইট তখন নির্ভেজাল লাগত—যেমন লাগত সুকুমার রায় আর বনফুলের লেখা পড়ে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমাদের সেই হা হা হো হো করে কাটানো শোভন দিনে আমরা সব প্রমিত বাংলায় শীলিতভাবে কথা বলি। সাহিত্য পড়ি, বিজ্ঞান পড়ি, পৃথিবীর ইতিহাস পড়ি, পড়ি দর্শন। বইয়ে পড়া সেইসব জ্ঞান নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। ফুল, বৃক্ষ, শিল্প, নন্দন, সৌন্দর্য, দর্শন নিয়ে ভাবি আর ভাবি যে জীবন স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর, স্বপ্নের চেয়েও বড়! কিন্তু রাইসু আড্ডায় এইসব স্বপ্ন, সুন্দর নিয়ে কথা বলে না! বরং চারপাশের বাস্তব জীবন, সময় ও সম্পর্ক নিয়ে নির্দ্বিধায় ‘র’ তামাশায় রসে মজে থাকে!
আমাদের দেশ তখন সামরিক শাসক মেজর জিয়ার কাল শেষ করে মেজর জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসন-শোষণে আছে। কিন্তু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছেলেমেয়েরা মানে আমরা নন্দন আর সৌন্দর্যতত্ত্বের রহস্য বুঝতে নিমগ্ন। আমাদের তখন সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা নেই। আমরা তখন দলবদ্ধভাবে বাঙালির ইতিহাস পড়ি কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পড়িও না, ওসব নিয়ে কথাও বলি না। আমরা ‘স্বপ্ন’ নিয়ে কথা বলি কিন্তু ‘জীবন’ নিয়ে ভাবি না। ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’—সায়ীদ স্যারের মুখে বহুবার শোনা এই কথা তখন আমরা অনেকেই আপ্তবাক্য হিসেবে নিয়ে নিয়েছি। শিল্প সাহিত্য আর সৌন্দর্যের এক অলীক বাস্তবের মধ্যে মনের আনন্দে আমরা সব নবীন প্রাণেরা চলছি ফিরছি। এই সময় রাইসু এসেছিল আমাদের মধ্যে—ওর ঝাঁঝালো উইট নিয়ে।
রাইসুর উইট অন্যরকম। রাইসুর উইটে সব সময় হাসা যায় না। রাইসুর দেখার চোখ ছিল তীক্ষ্ণ। সমাজ শ্রেণী আর মানুষে মানুষে সম্পর্কের পোশাক ছাড়া কঙ্কালটা নিয়ে রাইসু ব্যঙ্গ করত নির্দ্ধিধায়। সেই বয়সে আমাদের শীলিত শোভন মধ্যবিত্তিক সীমানার বাইরের জীবনটাও সম্ভবত ওর দেখার সুযোগ হয়েছিল। রাইসুর রসিকতায় ওর দেখা জীবনের নির্যাস থাকত। ফলে রাইসুকে অস্বীকারও করা যেত না। এহেন প্রবল তীব্র ধারালো প্রাণবন্ত রাইসুর উপস্থিতি সাহচর্য অনেকেই এড়িয়ে চলতে চাইত।
মনে পড়ছে আমাদের পরের ব্যাচের নিঘাতের বিয়ে খেতে যাওয়ার কথা। নিঘাত দেওয়ান নামে শান্ত চুপচাপ খুব সুন্দর এক মেয়ে ছিল। নিঘাত কথা তেমন বলত না। কিন্তু নিয়মিত কেন্দ্রে আসত। সম্ভবত ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পরপরই প্রবাসী পিএইডিধারী সুদর্শন এক ভদ্রলোককে পারিবারিকভাবে বিয়ে করে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল কেন্দ্রের খুব কাছে ইস্কাটনে সোহাগ কমিউনিটি সেন্টারে। রাতে ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি কেন্দ্রে আমাদের চেনাজানা ছোটবড় সবাই সেখানে আমন্ত্রিত। আমি আর শিমু (নাহিদ ইসলাম শিমু) ঢুকছি যখন দেখলাম সায়ীদ স্যার তাঁর গাড়ি থেকে নামছেন। সাথে লুনা আপা (স্যারের বড় মেয়ে লুনা সায়ীদ), মাযহার ভাই (আহমাদ মাযহার, লেখক); আমীরুল ভাইসহ (আমীরুল ইসলাম, শিশু সাহিত্যিক/ ছড়াকার) আরো কেউ থাকতে পারেন। ওনারা ঢুকেছেন সবে; সব পরিচিতরা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছি সেই সময় দেখি রাইসু, সাজ্জাদ ভাই (সাজ্জাদ শরিফ) এবং আরো দু’চারজন যারা একসাথে আড্ডা দিত—গেট দিয়ে ঢুকছে। ওদের দেখেই মাযহার ভাই বেশ বিরক্ত হলেন। বলে উঠলেন, এই রাইসু গংকে কে বলেছে বিয়ের কথা?
কে বলেছিল জানি না। নিঘাতই ওদেরকেও ইনভাইট করেছিল কিনা জানি না। কিন্তু ওরা কল কল করে এলো, ঘটা করে খেলো, সকলের সঙ্গে আড্ডা দিল। সেই আড্ডায় সায়ীদ স্যার ছিলেন মধ্যমনি। স্যারের সাথে সমানে সরব সরস আড্ডা দিয়ে রাইসুরা সুন্দর বেরিয়ে গেল। সেই আড্ডায় মাযহার ভাই, আমীরুল ভাইও সম্ভবত যোগ দিয়েছিলেন!
তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আমতলা কিংবা খোলা ছাদের অবারিত আড্ডায় চৌকশ সকলে সাজ্জাদ ভাইকে (সাজ্জাদ শরিফ—তখন তাকে আমরা কবি হিসেবেই চিনতাম, এখন তিনি ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো) খুব গুরুত্ব দিত। গুরুত্ব দিত মানে তাকেই তখন সবচে বেশি পড়ুয়া জ্ঞানী মনে করা হতো। সাজ্জাদ ভাইও খুব শার্প ছিলেন। তারও উইট খুব ভালো। সমবয়সীরা কেউই তেমন রাইসুর বন্ধু হলাম না। কিন্তু চটজলদি সাজ্জাদ ভাই আর রাইসু খুব বন্ধু হয়ে গেল। মানে তখন তাদের দুজনকে বেশির ভাগ সময় একসাথে দেখতাম। রাইসু আরো বন্ধু হলো আমাদের ঠিক আগের ব্যাচের ফাকরুল ভাইয়েরও। ফাকরুল ইসলাম চৌধুরীও তখন প্রখর মেধাবী বলে পরিচিত। ধারালো তিন মেধাবী তাদের সরস আড্ডায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদ সরগরম রেখেছেন তখন।
ক্রমে ওদের সেই সার্কেলে যুক্ত হলো আরো প্রখর দর্শনচক্রের তীব্র, জিয়া, মাহফুজ। বইপড়া কর্মসূচি শেষে আমি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি। তারও পরে প্রায় বিনা বেতনে লাইব্রেরিতে কর্মী হয়েছি। পাঠচক্র শেষে আমি তখন প্রতিদিন বিকেলে কাজের সূত্রেই কেন্দ্রে যাই। নিজের পাঠ বা বুদ্ধি ধারালো না হলেও রাইসু-সাজ্জাদ ভাইদের সাথে আড্ডা দেই। সেই আড্ডা কেন্দ্রের ছাদ থেকে শাহবাগ, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বর, ধানমণ্ডির দুই নম্বর সড়কে জার্মান কালচারাল সেন্টারের মিলনায়তনে গিয়েও ঠেকে। অনেক দিন এমন হয়েছে, বাংলা মটর থেকে এক রিকশায় আমি রাইসু সাজ্জাদ ভাই ছবি দেখতে জিসিআই গেছি। রিকশায় হেলান দেওয়ার চিকন পিঠ-দেয়ালে উপরে রাইসু বসেছে আর একপাশে আমি অন্যপাশে সাজ্জাদ ভাই। এমন যোগাযোগ ছিল আমি পুনায় পড়তে যাওয়ার ঠিক আগে পর্যন্ত। মানে ১৯৯৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমাদের ব্যাচের বইপড়া কর্মসূচির অন্যরা তখন সেই সব আড্ডায় আর নেই বললেই চলে।
১৯৯৫-এর পর আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রবেলা শেষ হয়। আমি অবশ্য তখনও পুনায় (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সস্টিটিউব অব ইন্ডিয়া, পুনে) পড়ছি। সেখান থেকে ১৯৯৭-এর মার্চে ঢাকায় যখন ফিরলাম তখন কোনো কিছুই আর আগের মতন নেই। মানে আমাদের ছাত্রবেলার মতন নেই। সব জায়গায় বন্ধুদের বেশির ভাগই পূর্ণকালীন কাজে ঢুকে গেছে। কাজের সূত্রেই আমাদের সকলের সামাজিক অবস্থান বদলে যেতে থাকে। সময়ও কমতে শুরু করেছে, বেতনের টাকায় অর্থশক্তি বেড়েছে, সকলেরই আড্ডার সঙ্গীও পাল্টে যেতে থাকে।
বদলই সমাজের নিয়ম। ফলে আগে যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল প্রতিদিনকার ঘটনা, সেসব আর থাকল না। তবে কেমন করে যেন রাইসুর সঙ্গে যোগাযোগটা রয়ে গেছে। আমার সেন্স অব হিউমার তেমন নেই। বুদ্ধিতেও তেমন চৌকষ নই। তবুও সেই ১৯৮৮ সাল থেকে এই যোগাযোগটা থেকে গেছে। সেই থাকাটা এই এখন রাইসুর যখন পঞ্চাশ হচ্ছে—আমার হবে আর আড়াই বছর পর, তখনও আছে। আছে বলেই এখন লিখছি এই লেখা, আমাদের ব্রাত্য রাইসুকে নিয়ে। লেখা ক্রমশ লম্বা হয়ে চলেছে!
রাইসুকে নিয়ে লেখা মানে কিছুটা নিজেকে নিয়েও লেখা। আমাদের তারুণ্যের কিছু সময় ঘটনা ও মানুষকে ফিরে দেখা!
আমাদের ছাত্রবেলায় সেটা সম্ভবত ১৯৮৯/৯০/৯১ সাল হবে। মঈন ভাই (মঈন চৌধুরী) ছোট কাগজ ‘প্রান্ত’ করবেন। সম্পাদনায় রাইসু। আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। ইংরেজি তেমন জানি না। তবুও কেন যে ভরসা করে রাইসু প্রান্ত-এর জন্য গুন্টার গ্রাসের ‘দ্য টিন ড্রাম’ নামে একটি লেখা [‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাস লেখার গল্প] আমাকে অনুবাদ করতে দেয়! মূল লেখাটি জার্মান ভাষায় লেখা; ওটা ইংরেজি থেকে বাংলা করতে গিয়ে আমি বাংলার ঢঙে অনুবাদ করেছিলাম। ‘প্রান্ত’ প্রেসে পাঠাবার আগে সম্পাদক মশাই লেখাগুলো নিয়ে বসেছিল মঈন ভাইয়ের বাসায়। সেখানে ইংরেজির সাথে মিলিয়ে পড়তে গিয়ে দেখা গেল অনুবাদে আমি গুন্টার গ্রাসের বেশ কিছু বাক্যের অর্থই একশো আশি ডিগ্রি বদলে দিয়েছি! (ইংরেজি ঠিকঠাক না জানায় এমন বিপত্তি ঘটিয়েছিলাম।) ওই একই প্রকাশনার জন্য প্রিসিলা (প্রিসিলা রাজ) করেছিল জাঁক দেরিদার বিশাল এক প্রবন্ধের অনুবাদ। প্রিসিলা ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী। ইংরেজি ওর সমস্যা নয়। কিন্তু অনূদিত বাংলা লেখাটি আমাদের সম্পাদক মশায় (রাইসু) আরো ঘষামাজা করতে চাইলেন। তখন মঈন ভাইয়ের বাড়ি শান্তিনগর। ওখানেই মঈন ভাইয়ের নিচতলার বসার ঘরে রাইসু তার বাহিনী নিয়ে সম্পাদনার কাজ করছিল। প্রিসিলার করা দেরিদার লেখা নিয়ে ওর সাথে রাইসু বসল আর আমার করা গুন্টার গ্রাসকে ঘষামাজা করার জন্য বসলেন জুয়েল ভাই (কবি, সাংবাদিক জুয়েল মাজহার)। আমি আর প্রিসিলা ইউনিভার্সিটির ক্লাশ শেষ করে বিকেল বা সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে শান্তিনগর চলে যেতাম। সেখানে দলেবলে সদানন্দে সরস আড্ডাময় বিনে পয়সার কাজ শেষে বাড়ি ফিরতাম। কোনো কোনো দিন অফিস শেষে সাজ্জাদ ভাই (তিনি তখন জীবন বীমা কর্পোরেশনে কাজ করেন) আসতেন, মঈন ভাইও উপর থেকে নেমে আসতেন। যতদূর মনে পড়ে, রাজু আলাউদ্দিন আয়শা ঝর্নাও মাঝেমধ্যে যোগ দিত। তুমুল তুখোড় আড্ডা শেষে আমি আর প্রিসিলা রমনা পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে সড়কবাতির ফিঁকে আলোয় কথা বলতে বলতে একসাথে শাহবাগ পর্যন্ত হেঁটে আসতাম। তারপর রিকশায় যে যার বাড়ি। তখন—প্রান্ত-এর কাজ করতে গিয়েই বুঝেছিলাম, রাইসু ব্যাকরণের সূত্র মুখস্থ বলে না—কিন্তু খুব সুন্দর এক্কেবারে নিজের মতন বাংলা লিখতে পারে! ওর সেই লেখালেখি এখনও জারি রেখেছে। সম্পাদনার কাজটাও সে নিজের মতন করেই করে চলেছে।
তো ব্রাত্য রাইসুই আমার প্রথম সম্পাদক। ও চেয়েছিল বলেই পত্রিকার জন্য লেখা দিতে শুরু করেছিলাম। লেখক হওয়া, লেখালেখি করে নাম করার ইচ্ছে স্বপ্ন বা কল্পনা কিছুই ছিল না আমার। কিন্তু ছোটকাল থেকেই স্কুলের খাতার সাথে আলাদা একটা খাতা ছিল। কিছুমিছু লিখতাম। কিন্তু কাউরে দেখাই নাই সেইসব। একান্ত আমার নিজের সাথে নিজের কনভারসেশন সেসব। আজিমপুর কলোনিতে আমাদের ছোট্ট বাসায় পড়ার টেবিলে রাখা থাকত। আমাদের খোলা বাড়িতে অনেক ভাই-বোনের শেয়ার করা ঘরে-টেবিলে গোপনীয়তা ছিল। কেউ কারোর জিনিস হাতাতাম না। ফলে বাড়িতে কেউ জানত না আমার গোপন সেইসব লেখালেখির কথা।
কী লিখতাম তখন? গল্প বা কবিতা? তখনও তো নাম জানি না কোনো ফর্মের। মনে আসত এমন কিছু সেই খাতায় লিখে রাখতাম। তো বন্ধুবেশী সম্পাদক রাইসু না বললে ‘প্রান্ত’-র প্রথম সংখ্যায় ওই অনুবাদ করা হতো না। নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার আরামও হতো না। আর ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার সেই আরাম, শাহবাগকেন্দ্রিক লেখক মহলে গুন্টার গ্রাসের লেখা অনুবাদে কিঞ্চিৎ প্রশস্তি নবীন বয়সে হয়তো আনন্দই দিয়েছিল। নইলে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই এখনও কেন আর কিছু না হোক যা ইচ্ছে তা-ই লিখে রাখতে চাই?
আমার ভেতরে খুব একলা একজন মানুষ আছে। একলা দুখি এক মানুষ। এক হাট মানুষের মধ্যে থেকেও তার একলা ভাব কাটে না। হা হা করা হাসিতেও বুকের মধ্যিখানের অবিরল কান্না থামে না। কারণে-অকারণে ভেতরের মন খারাপ করা চিনচিনে কান্না আপাত স্থির আমাকে খুব অস্থির করে রাখে। যেখানেই যাই মনে হয় হেথা নয়—অন্য কোথাও দূর কোনো অজানায় গিয়ে শান্তি হবে। কিন্তু হয় না। তো তখনও জানি না এর নাম বিষণ্ণতা। ভেতরে হাঙরের মতন ক্ষুধার্ত একলা আমিটার চিনচিনে কান্না সামলাবার জন্য আমি সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইতাম। বুঝতাম না প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কী—কিন্তু বিনা প্রশ্নে প্রচলে চলায় অনীহা ছিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক যেভাবে পড়ানো হয়েছে সেটা পছন্দ ছিল না। কিন্তু তার বিকল্প কী—বা কীভাবে পড়লে সেই বিষয়গুলোকে নিজের মতন করে বুঝে নিয়ে নিজের মত তৈরি করতে পারব সেইটা তখন নিজে বুঝি নাই, মুখস্থ করার অভ্যাস কোনোকালেই ছিল না। ভালো ফলে টার্গেট ছিল না—বুঝতে চাইতাম, অনুধাবন করতে চাইতাম। বোঝার মতন কোনো গাইডেন্সও পাই নাই। ফলে মোটামুটি মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় মুখস্থ নির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতিতে আমার ফল সবসময় মাঝারি মানের। এই ফল নিয়ে অসন্তুষ্টি নেই। কিন্তু আমার আত্মা সব সময় অতৃপ্ত থেকেছে। আমি তাই আশ্রয় খুঁজে বেড়াতাম আমার গোপন লেখার খাতায়, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বইয়ে, চিত্রকলার প্রদর্শনীতে, বিনে পয়সায় পাওয়া চলচ্চিত্রের শোগুলোতে। ছিল দলে-বলে আড্ডা আর অকারণ ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু বিষাদময় মন তারপরও কামড়ে চলত। বিষণ্ণ মনের চিকন কান্না থামানোর জন্য আমার তাই দরকার ছিল আরও ব্যস্ততা। আবার নারীবাদী কোনো লেখা না পড়েও পরাধীন মেয়ে জীবনের প্রধান অন্তরায় তখন মনে হয়েছিল আর্থিকভাবে বাবার উপর নির্ভরশীলতা। নিজেকে স্বাধীন মানুষ করার জন্য বাবার কাছ থেকে কোনো টাকা না নেওয়ার পণ করে বসেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরপরই। এই পণ বজায় রাখতেও আয়মূলক কোনো কাজের সাথে যুক্ত রাখতে চাইতাম নিজেকে। সেইজন্যই পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নামমাত্র বেতনে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে একসময় সেখানে কিছু বিষয়ে স্ববিরোধিতা দেখে হুট করেই কাজ ছেড়ে দেই। কিন্তু আমাকে তো স্বাধীন হতে হবে। পরে আমি তাই খুঁজে নিয়ে পত্রিকায় কাজ শুরু করি। তখন দু/তিনটি পত্রিকায় কাজ করা হয়েছিল।
একবার কাজ পেতে রাইসুও হেল্প করেছিল।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি। এর আগে যেখানে কাজ করতাম কী কারণে যেন সেটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ক্লাশ শেষে ইউনিভার্সিতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় শাহবাগ যাই। সেখানে রাইসু, সাজ্জাদ ভাইসহ অন্যদের সঙ্গেও আড্ডা শেষে বাসায় ফিরি। রাইসু তখন বাংলাবাজার পত্রিকায় কাজ করে। বাংলাবাজারের সাহিত্য সম্পাদক নামে ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। রাইসু কাগজেপত্রে সম্ভবত সহকারি সাহিত্য সম্পাদক ছিল। কিন্তু বাস্তবে রাইসুই ছিল সাহিত্য সম্পাদক। তারেই আমি করতে দেখেছি সবকিছু। গুণদা কেবল পেজমেকাপের দিন অফিস আসতেন। শাহবাগেই বোধহয় রাইসুকে বলেছিলাম—আমার কাজ দরকার। তো রাইসু আমারে ওদের অফিসে যেতে বলল। গেলাম। মহাখালিতে নাবিস্কোর পাশে তিব্বত ভবনেই বোধহয় তখন বাংলাবাজার পত্রিকার অফিস। সম্পাদক ছিলেন মতিউর রহমান চৌধুরী।
রাইসু সম্পাদকের ঘরে নিয়ে গেল আমাকে। বলল, আমার এই বন্ধুর কাজ দরকার। মতিউর রহমান চৌধুরী আমি বাংলায় পড়ি শুনলেন। ইউনিভার্সিটির ক্লাশ শেষে দুপুরের পর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিস করতে পারব শুনে আমাকে সরাসরি প্রুফ রিডিং বিভাগে জয়েন করতে বললেন। দৈনিক পত্রিকায় প্রুফ রিডিং করিয়েরাই সবচে অবহেলিত, ক্ষমতায় কমজোরি। বেতনও সম্ভবত কম। আমি ঠিক প্রুফ রিড করার কাজ নিতে চাইছিলাম না। রাইসুই আমার দ্বিধা সরাতে হেল্প করল। বলল, করো। তুমি তো নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাও। ব্যস্ততার বিনিময়ে টাকা পাবে। অসুবিধা কী?
প্রুফ সেকশনে জয়েন করলাম। ওখানে যাঁদের সাথে কাজ করেছি তাঁরা বোধহয় একটু অস্বস্তিই বোধ করতেন। প্রুফ সেকশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পড়ুয়া শহর ঢাকার কোনো মেয়ে বোধহয় তখন কাজ করত না। তবে তাঁরা আমাকে খুব আদর যত্ন করতেন। আর অবাক হয়ে দেখলাম, পদ মর্যাদায় প্রুফ সেকশনের কর্মীরা কম হলেও ভাষাজ্ঞানে তাঁদের উপরের পদধারীদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। আর কেবল ভাষাজ্ঞান নয়—ভাবনা, বোধে, আচরণেও সেখানকার অন্য অনেকের চেয়ে বেশি ঋদ্ধ ছিলেন তাঁরা। বেশিদিন ওখানে কাজ করা হয় নি। পুনায় স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে চলে যাওয়ার আগে যে দুই/তিন মাস ওখানে কাজ করেছি তখন দেখেছি সেখানকার দারওয়ান, পিয়ন, পেস্টার, কম্পোজার—সকলের সাথেই রাইসুর বেশ সহজ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আর রাইসুই আমার বন্ধুদের মধ্যে সেইজন যার সাথে একই অফিসে ভিন্ন পদমর্যাদায় কাজ করলেও আচরণে কোনো প্রকারভেদ করে নি।
তো তখন বাংলাবাজারে থাকাকালেই রাইসু সাহিত্যপাতার জন্য আমাকে লিখতে বলে। ও-ই ওর পাতার জন্য এস. এম. সুলতানরে নিয়ে লিখতে বলে। সুলতান মারা যাবার পরে কি? মনে নাই। রাইসুই বলতে পারবে। তখনই প্রথম আমার কবিতা ছাপা হয়। দু’চারজন আবার সেই কবিতা পড়ে প্রশংসাও করেন! তারপর অনলাইনে রাইসু ‘কবিতা সঞ্চালন’ নামে একটা পাতা খোলে। সেখানেও লেখা চায়। এবং আজব যে আমি আমার সেই গোপন খাতায় লেখা দু’একটা কবিতা দেই। ছাপা হয়। আজব যে তুখোড় কবিদের কেউ কেউ অকবি আমারে তখন কবি হিসেবে চেনেন—ইমেইল পাঠিয়ে প্রশংসাও করেন! পরে রাইসু যখন বিডিনিউজ ২৪-এর আর্টস পাতা চালায় সেখানেও মাঝেমধ্যেই তাগাদা দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে নানান কিছু। আমি না কবি, না প্রাবন্ধিক। ইচ্ছে যা হয় লিখি তাই-ই। এর যে কোনো সাহিত্যমূল্য আছে সেটা নিয়ে ভাবি নাই কখনও। তবে এটা ঠিক সম্পাদক ব্রাত্য রাইসু তাড়া দিয়ে লেখা না চাইলে আমার অনেক লেখাই হতো না হয়তো। আবার আমার পাঠানো দু’একটা লেখা বিশেষত কবিতারূপী কোনো লেখা মানে ঋদ্ধ না হলে বাতিলও করেছে। আজব যে তাতে আমি মাইন্ড খাই নি। জানতে চাইলে বলত, এটা ছাপা হলে পরে তোমারই আর ভালো লাগবে না। একটা অনুচ্চারিত আস্থা ছিল, এখনও আছে। এখনও মনে হয়, ট্রু অপিনিয়ন রাইসুই বলবে—সে ভালো কিংবা মন্দ।
তো এই আমার বন্ধু রাইসু। যার সাথে সেই অর্থে কোনো যোগাযোগ নেই। যোগাযোগ না থাকলেও যাকে দূরের মনে হয় না। আবার এটাও জানি আমরা খুব কাছেরও নই। না দূর-না নিকট এমন আস্থার বন্ধু আমার রাইসু। এখন
এখন এই ভার্চুয়াল উঠানেই কেবল আমাদের নিয়মিত দেখা হয়। কথাও তো ভার্চুয়াল উঠানেই ওর ওয়ালে দেওয়া স্ট্যাটাস পড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কদাচ কদাচিৎ কখনো এখানে সেখানে টুকরো টাকরা দেখা হয়। তখন কথা বলতে হাসি বিনিময়—বড়জোর কেমন আছো জানতে চাওয়া। তারই মধ্যে যতটুকু ওকে দেখি—দেখি রাইসু আগের মতনই আছে।
আগের মতন? সেই তিরিশ বছর আগে দেখা হওয়া বিশ বছরের তরুণ? তরুণই হয়তো। পঞ্চাশে লোকে যেমন ভারি হয় দেখতে, চলনে, বলনে—রাইসু তেমন হয় নাই। কিন্তু আমার কাছে রাইসুকে আগের মতনই লাগে। কারণ ও দেখি আগের মতন ওরই মতন করে আছে। জীবনের গতিপ্রবাহ সময়ের বাঁক বিভঙ্গ মানুষ রাইসুকে অন্য এক মানুষ বানিয়ে ফেলে নাই। আগের মতনই ওরে অকপট, আড়ম্বরহীন মনে হয়। সমাজের প্রচলকে ভাঙার কোনো প্রতিবাদী ঘোষণার আড়ম্বর না করেও রাইসু ওর মতন করেই জীবনটাকে যাপন করে চলেছে। এইজন্য রাইসুকে আমি বন্ধু বিবেচনা করি। স্বভাবে, গুণে আমার চাইতে ভীষণ রকম আলাদা মানুষ হলেও রাইসু আমার বন্ধু।
তবে আমি ওর বন্ধু কি? না, জানি না! এই নিয়ে কথা বলি নাই আমরা। কখনো। প্রয়োজন হয় নাই বলার।
২০/১২/২০১৭
ফৌজিয়া খানের লেখাটি পড়ে ভালো লাগল । কী সুন্দর লেখা, রাইসুকে নিয়ে এই লেখাটি পর পর দুইবার পড়লাম । এতে করে ফৌজিয়াকেও কিছুটা জানা হলো । আচ্ছা, এই ফৌজিয়া কি লুভা আপাকে সঙ্গে করে আমাদের বাসায় এসেছিলেন এক সন্ধ্যায়, আমার আর্ট এগজিবিশনের বিষয়ে কথা বলতে ? নিউজলেটার রাইসু-র গ্রাহক হয়েছি আজ, ফ্রিতে । ভালো লাগছে । ফ্রি-এর জন্য নয়, ভালো লাগছে এই ভেবে যে পড়বার মতো একটি নিউজ লেটার পেলাম, যা পড়ে আমার আনন্দ হবে ।