‘শাহবাগ’-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের সলিমুল্লাহ বিরোধিতা
২০১৩ সালে বহু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের গণজাগরণ মঞ্চ করতে ও সমর্থন দিতে দেখা গেছে। এইটা দুঃখজনক।
তাদের সেই সমর্থন ও রাজনীতির কারণে এখন দেশে ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্য কায়েম হইছে। সেই সময় এই আন্দোলনের জোরে গণদাবি ও ফাঁসি চাহিদার অজুহাতে যুদ্ধাপরাধের শাস্তি হিসাবে বিরোধী দলের কয়েকজন নেতাকে তড়িঘরি ফাঁসি দেওয়া হইছিল। এগুলি সবই একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যে কলঙ্কের অধ্যায়।
২.
ওই সময়ে সলিমুল্লাহ খানসহ আরো কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর গণজাগরণ মঞ্চ বা ‘শাহবাগ’ সমর্থনের ইতিহাস নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক।
তাদেরকে নিন্দা করা যায়, গণতন্ত্রহীনতা ডাইকা আনার জন্যে অভিশাপও দেওয়া যায়। কিন্তু যেইটা করা যায় না তা হইল, তাদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় না।
আমার আলাপের মূল বিষয় এইটাই। কারো ভুল রাজনীতির কারণে তার বুদ্ধিজীবিতাকে খারিজ করা যায় কিনা?
আমি মনে করি, যায় না।
যেইভাবে সকল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের খারিজ করা হয়, এই খারিজও সেই একই বিচারহীন ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
২০১৩ সালে গমঞ্চ করার কারণে তাদের বুদ্ধিজীবিতাকে আপনি খারিজ করতে পারবেন না। যেইটা করা যায় তা হইল,
তাদের তৎকালীন ‘শাহবাগ’ সমর্থন বিষয়ক বুদ্ধিজীবিতার সমালোচনা ও নিন্দা। তা করতে হইলে তাদেরকে বুদ্ধিজীবী স্বীকার কইরাই সেই আলোচনায় ঢুকতে হবে আমাদের।
৩.
আমি একদমই শুরু থিকা গণজাগরণ মঞ্চের সমালোচনা কইরা আসছি, তাই বইলা যারা গমঞ্চ সমর্থন করছেন তাদেরকে ঘৃণার বিষয় কইরা তোলার যে বুদ্ধিজীবিতা শুরু হইছে এইটারে সমর্থন করি না।
মঞ্চ সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের সামগ্রিক কাজকর্মরে মূল্যহীন কইরা দেওয়ার যে ‘শাহবাগ’-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিতা এইটারে আমি গণজাগরণ মঞ্চের মতই বিপজ্জনক জ্ঞান করি।
যেমন আপনারা জানেন, যুদ্ধের পরে তৎকালীন রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের ঘৃণাজীবিতাকে আমি নিন্দা করি।
একটা দেশে সবাইকে যখন একত্রে বসবাস করতে হবে সেখানে পারস্পরিক ঘৃণা সমাজকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব ভাবেই পশ্চাৎমুখী কইরা তোলে। দেশে তখন গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজ করে।
মঞ্চ সমর্থক বুদ্ধিজীবীদেরকে অস্বীকার করার বা মূল্যহীন করার যে গণ প্র্যাকটিস শুরু হইছে এর মধ্যে সেই লক্ষণ ফুইটা উঠতেছে। এইটা হচ্ছে কিছু বুদ্ধিজীবীর অন্য বুদ্ধিজীবীদের উপর সুযোগ নেওয়ার কৌশল। বুদ্ধিজীবিতাকে চরদখলের জিনিস বানাইয়া তোলা।
যেইসব বুদ্ধিজীবী শাহবাগ আন্দোলন করছিলেন তাদের সেই সমর্থনের কারণে তাদের বুদ্ধিজীবিতা শূন্য হইয়া যায় নাই। তারা গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যুতে অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রে ফেইল করছিলেন এমন বলা যায়। এই রকম ফেইলিওর বা ভবিষ্যৎ বিরোধী কাজ সব বুদ্ধিজীবীর জীবনেই ঘইটা থাকে। তার ব্যর্থ বা ভুল কাজের সমালোচনা করা যায়, কিন্তু সেই ভুল থিকা বুদ্ধিজীবীটির সামগ্রিক কাজের উপসংহার টানা যায় না।
এবং কোনো বুদ্ধিজীবীর সার্বিক বুদ্ধিজীবিতা বিচারের ক্ষেত্রে যেকোনো একটি ব্যর্থতার গুরুত্ব কম। বরং যেখানে বুদ্ধিজীবীদের কাজ দেশ ও জাতির অগ্রগতি সাধন করে সেইটারেই গণনা করতে হয়। কারণ ফোকাসের কেন্দ্রে বুদ্ধিজীবী থাকে না, থাকে দেশ।
মঞ্চ সমর্থকদের বুদ্ধিজীবিতা আসলে যে বুদ্ধিজীবিতা না বা টিকবে না এই রকম প্রচার করাটা হইল বুদ্ধিজীবী হিসাবে নিজের চ্যানেল পরিষ্কার করার চেষ্টা। গমঞ্চ করছে সুতরাং বুদ্ধিজীবী হিসাবে ওরা ভবিষ্যতে টিকা থাকবে না--এই রকম আশা কুহকিনী আশা।
বুদ্ধিবৃত্তিক সব কাজকর্মরে শুধুই গণজাগরণ মঞ্চ বা শাহবাগরে কেন্দ্র কইরা ঘুরানোর ব্যবস্থাটা ইদানিং দেখা যায়। এইটাও আরেক ভার্চুয়াল গণজাগরণ মঞ্চই। এই শাহবাগ কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের থিকা সাবধান।
৪.
আমি নিজে ফাঁসি বিরোধী, কিন্তু তাই বইলা যারা ফাঁসির পক্ষে তাদেরকে মানুষ মনে করি না, এমন না।
যারা আইন মানে না কিংবা ফাঁসি চায় তাদের সেই অবস্থান রাজনৈতিক, এই রাজনীতিরে রাজনীতি দিয়াই ঠেকাইতে হবে।
আবার সেই রাজনীতির মাধ্যমে তাদেরকে একঘরে করার চেষ্টা যদি করেন, একই মন্দ কাজ হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা যারা করেন তারা আবার সেই মঞ্চেরই দর্শন অবলম্বন কইরা দেশে যদি গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকেন তবে একই সমস্যা তারা জিয়াইয়া রাখতেছেন।
৫.
বুদ্ধিজীবীকে জাতির বিবেকের বা রাজনৈতিক নেতার দায়িত্ব দেওয়া যায় না। ওইটা তাদের চাকরি না। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীর কাজ সরাসরি জাতির সঙ্গে না। জাতির সঙ্গে কাজ রাজনীতিবিদদের। বুদ্ধিজীবীরা এমনকি জাতি বিরোধীও হইতে পারে। বুদ্ধিজীবী নিজে যা সঠিক মনে করে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশের মাধ্যমে সেইটার ভিত্তি রচনা করে। বা সেই ধরনের আইডলজিতে সমর্থন দেয়।
যারা শাহবাগ আন্দোলন করার কারণে আজকে অনুশোচনা করে তারা যেমন বুদ্ধিজীবী আবার যারা করে না তারাও বুদ্ধিজীবীই।
আপনি গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধী কাজেই ওনারা কেউ বুদ্ধিজীবী হিসাবে টিকা থাকবেন না এই রকম যখন বলেন তখন আপনি শাহবাগ বা গণজাগরণ মঞ্চ কেন্দ্রিক জ্ঞানশাখা খুলতে চাইতেছেন।
এবং শাহবাগে ওই ব্যক্তি কোন পক্ষে ছিল এইটারেই বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবিতার একমাত্র মানদণ্ড বা প্লাটফর্ম ধইরা নিছেন!
সব বুদ্ধিজীবী সব ব্যাপারে সঠিক কথা বলবেন না, তাতে তাদের সমস্ত অর্জন ধূলিস্মাৎ হইয়া যায় না। যেইখানে ওনারা ভুল সেইটা ধরানোর পরেও তাদের বিরুদ্ধে আপনার যদি কাজ অবশিষ্ট থাকে সেইটা কোনো বুদ্ধিজীবিতার কাজ না, বরং রাজনীতির কুচক্র। এবং এই রাজনীতিরে সচরাচর কুৎসিত রূপেই দেখা যায়। কারণ এই রাজনীতি আপন বুদ্ধিজীবিতারে কূটকৌশল হিসাবে ব্যবহার করে।
সলিমুল্লাহ খানের শাহবাগ বা গণজাগরণ মঞ্চ সমর্থনের কারণে তার অন্য সকল বুদ্ধিজীবিতারে আযান দিয়া খারিজ করার যে অ্যাকশনসমূহ দেখা যাইতেছে, তারে এই ‘শাহবাগ-কেন্ত্রিক বুদ্ধিজীবিতা’র চরদখলের আলোকেই বিবেচনা করতে হবে।
২৩/৩/২০২৪